প্রধান সূচি

ফেলে আসা দিন গুলো-দুই

এবাদত আলী

আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহমান এই নদীকে লোকজন বলতো বাঙ্গর নদী। এই নদী বারো মাসই পানিতে টৈটুম্বর থাকতো । বর্ষার সময় দারুন স্রোত থাকতো নদীতে। পাল তোলা বড় বড় নৌকা চলতো অবাধে। এই নদী দিয়ে চাঁদ সওদাগরের বানিজ্য তরি গমণাগমন করতো বলে ঐতিহাসিক রাধারমন সাহা লিখিত পাবনা জেলার ইতিহাসে তা উল্লেখ রয়েছে, এবং সেখানে এই নদীকে রতœাই নদী হিসেবে উল্লেখ করা আছে।
নদীতে গোসলের নামে দল বেঁধে সাঁতার কাটতাম, ডুব ডুব খেলতাম। ডুব দিয়ে নদীর গহীন তলদেশ হতে কাঁদা-মাটি তুলে আনার প্রতিযোগিতায় নামতাম। ¯্রােতে ভেসে গিয়ে আবার উজানে আসার প্রতিযোগিতা হতো। আমাদের পরনে থাকতো হাফ প্যান্ট, কারো বা লুঙ্গি। হাফ পেন্টে তখন কোন চেইন সিস্টেম ছিলনা ছিলনা কোন পকেট। এছাড়া আন্ডারওয়ারও অনেকে পরতো। লুঙ্গি যারা পরতো তারা মালকোচা মারতো, কেউবা আবার কাছা দিতো। আমরা একবার পানিতে নামলে আর পানি থেকে উঠতে চাইতামনা। কারো কারো মা-বাবা বাঁশের কঞ্চি হাতে ধেয়ে আসতো। পানি থেকে ওঠা মাত্রই সপাং সপাং করে কঞ্চির বাড়ি পড়তো তাদের পিঠে। তা দেখে আমরাও ধীরে ধীরে পানি থেকে উঠে বাড়ির দিকে ভোঁ-দৌড় দিতাম। বাড়ি পৌঁছে মায়ের বকুনি যে খাইনি এমন দিন খুব কমই ছিলো। পানি থেকে উঠামাত্র চোখের মনি রক্তের মত লাল দেখাতো।
আবার বিকাল হতে না হতেই লাল গামছা খানা পরনের লুঙ্গি অথবা হাফ প্যান্টের উপর পেঁচ দিয়ে বেঁধে পাড়ার সঙ্গি-সাথিদের বাড়ি গিয়ে হাজির হতাম। দলবদ্ধ ভাবে চলতো খেলা-ধুলা। কখনো বদন খেলা, কখনো, হাডুডু, কখনো গুলডাইং, আবার কখনো মালাম খেলা (মল্ল যুদ্ধ) চলতো। কোন কোন দিন আমরা মার্বেল খেলতাম। খেলতাম দশ কড়ির খেলা। বাঘপাতি নামক আরেকটি খেলারও প্রচলন ছিলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলা-ধুলা করে বাড়ি ফিরতাম। কোন কোন দিন বকুনি আবার কোন কোন দিন মায়ের হাতের মার খেতে হতো। এমনি ভাবে দিন কাটাতে গিয়ে লেখা-পড়ার সময়ই পেতাম না আমরা।
কিন্তু সেদিনের জালছায় এস্কেনের কোরআন তেলাওয়াত শুনে স্কুলে যাবার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। পথে আসতে আব্বাকে বললাম। বাড়ি এসে আম্মাকে। তারা আমার কথা শুনে খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে উঠলেন। আমাদের জমির খাজনা আদায়কারি আজগর মামাতো দারুন খুশি। তিনি বল্লেন যাক বাবা বাঁচা গেল। ছেলে লেখাপড়া শিখলে সে নিজেই খাজনা আদায়ের কাজ করতে পারবে। অবশ্য সে চিন্তা আর বেশি দিন করতে হয়নি। তখনকার পাকিস্তান সরকার ইষ্টবেঙ্গল টেনেন্সি এ্যাক্টের বলে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করলে আমাদের নামমাত্র জমিদারি বিলোপ সাধিত হলো। বিনিময়ে সরকারের নিকট থেকে কম্পেনসেসন বা ক্ষতিপুরণ পাওয়া গেল।
যাক আমি স্কুলে পড়তে যাবো একথা শোনার পর আমার দুর সম্পর্কের ভাই সামাদ এর মেয়ে আছিয়াতো মহা খুশি। কারণ মাঝে মধ্যে আমার ভাতিজি আছিয়া আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে পড়াতো। আছিয়ার পিতা আব্দুস সামাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ থাকায় ছোট বেলা আছিয়াকে এক বাড়িতে পাঠানো হয়। পাবনা শহরের খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিনের মেয়ে সেলিনা বানু তাকে পালিত কন্যা হিসাবে নেন এবং লেখাপড়া শিক্ষা দেন। কয়েক মাস পরপর আছিয়া বাড়ি আসতো এবং প্রায় মাস খানেক বাড়িতে থাকতো। সেই সময় সে আমাকে পড়াতো। বলতে গেলে আছিয়ার নিকটই আমার হাতে খড়ি।
আমি লেখা পড়া করতে যাবো। কিন্তু যাবো কোথায়? আমাদের গ্রামে এবং পাশের গ্রামেও কোন স্কুল নেই। আমাদর বাড়ির পশ্চিমে তিন মাইল দুরে দাপুনিয়ার পাশে একটি, পুবে দুমাইল দুরে রুপপুরে একটি (যার প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৫ সাল)। দক্ষিনে দুমাইল দুরে ভাঁজপাড়া একটি এবং দুমাইল দুরে জোতআদমে তখন প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় ছিলো। আর নিকটস্থ হাইস্কুল বলতে পাবনা শহরের রাধানগর মজুমদার এাডেমী বা আর এম একাডেমী স্কুল।
জোতআদম গ্রামে আমার মামা বাড়ি। বড় মামা জিয়ার উদ্দিন এবং ছোট মামা ওমেদ আলী একই আঙিনায় বসবাস করতেন। তাই জোতআদম স্কুলে যাবার জন্যই স্থির হলো। স্কুলে টিফিন হলে মামা বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়া যাবে বিধায় সেখানে ভর্তির বিষয় পাকাপোক্ত হয়ে গেল। কিš আমার ছোট ভাই সাহাদত আর আমি এত পথ যাবো কিভাবে। আমার অভিভাবক বৃন্দ পড়লেন দারুন ভাবনায়। আর এই ভাবনা অনেকটাই দুর হলো যখন আমার বাড়ির পাশের ডা. নজিম উদ্দিন নানার বড় ছেলে অর্থাৎ আমার মামা আফ্ফান আলীও সেখানে পড়তে যাবে একথা শুনে। তারও ফুফুর বাড়ি জোতআদমে। জোত আদমের আছের উদ্দিন মন্ডল তার ফুফা। স্কুলের কাছেই তাঁর বাড়ি এবং স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
আমাদের গ্রামের নাম বাদলপাড়া। পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের অধীনের এই গ্রামটি অজ পাড়াগাঁ। আমার পুর্ব পুরষ বাদল মালের নামানুসারে এই গ্রামের গোড়াপত্তন হয়। অতীতের নথিপত্র দৃষ্টে জানা যায় আমাদের পুর্ব পনুরুষগণ আগে নদীয়া বা কুষ্টিয়া জেলার তালবাড়িয়া নদীর চরে বসবাস করতেন। প্রমত্তা পদ্মা নদীর প্রবল ¯্রােত ও ভাঙনের ফলে তালবাড়িয়া গ্রমের ১৮ টি পাড়া এক রাতের মধ্যে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
গ্রামের বাসিন্দারা যে যার মত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে। আমার পুর্ব পুরুষের এজন বাদলমাল তার পরিবার পরিজন নিয়ে বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামের পশ্চিমে এসে বসবাস শুর করে। বাদল মালের নামানুসারে এই গ্রামের নামকরণ করা হয় বাদলপাড়া।
আমাদের সময় লেখা পড়ার চর্চা ছিলোনা বল্লেই চলে। এই গ্রামে তখন কোন উচ্চ শিক্ষিত লোক ছিলনা। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে ডা. নজিম উদ্দিন সামান্য কিছু লেখা-পড়া জানতেন এবং হাতুড়ে ডাক্তার ও কবিরাজ হিসাবে তিনি লোকজনকে চিকিৎসা সেবা দিতেন। ওষুধে যত কাজ না হতো তৎকালে তাঁর ঝাড়ফুকে তার চেয়ে বেশি কাজ হতো। তিনি তাই তখন একজন নামকরা চিকিৎসক হিসাবেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন। গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় ছিলেন ফয়েজ উদ্দিন মোল্লাহ। তিনি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলেন। ঐ পাড়াতেই ছিলেন ইয়ার আলী ফকির ও জবর আলী ফকির। জবর আলী ফকির বাংলা লেখাপড়া কম জানলেও আরবিতে তাঁর বেশ দখল ছিলো। তিনি কোরআন শরীফ তেলওয়াত করতে এবং জুমা’র নামাজে খুতবা পাঠ করতে পারতেন। তাই এলাকায় তাঁর কদর ছিলো বেশি। গ্রামের অফেজ উদ্দিন প্রামানিক কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে পারতেন (১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ)। আমার আব্বা নাম সই করতে পারতেন, আম্মা তাও পারতেননা। তবে উভয়েই ছিলেন পরহেজগার এবং পাঞ্জেগানা নামাজী। আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে নেপাল প্রামানিক ওরফে নেপলার বড় ছেলে আব্দুল কাদের ওরফে আবু তালেব সেসময় হাইস্কুলে পড়তেন। পরে লেখাপড়া বাদ দিয়ে তিনি রাজস্ব বিভাগে প্রসেস সার্ভার পদে চাকুরি লাভ করে গ্রামে একজন সরকারি চাকুরে হিসাবে গ্রামের মান-ইজ্জত রক্ষা করেন। আমার চাচাতো ভাই কুদরত আলী ও ফয়েজ মোল্লার ছোট ভাই আফসার আলী লেখাপড়া জানতেননা তবে তারা ভাসান যাত্রা, রুপবান যাত্রাসহ বিভিন্ন যাত্রা পালায় সুন্দর অভিনয় করতেন। বাদলপাড়া গ্রামে তখন আরেকজন চৌকশ ব্যক্তি ছিলেন আজগার আলী প্রামাণিক। তিনি লেখাপড়া জানতেননা বটে তবে দেশ-বিদেশের সকল খবরাখবর অবললিাক্রমে বলতে পারতেন। (১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শহীদ)। (ক্রমশঃ) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।