প্রধান সূচি

ফেলে আসা দিন গুলো- পাঁচ

এবাদত আলী
বাংগাবাড়িয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় প্রতি বছরই শীতকালে জালছায়ে আজিমুশ্নান অর্থাৎ বিরাট ইসলামি জালসা অনুষ্ঠিত হতো। বার্ষিকী এই জালসার দিন তারিখ আগেই ধার্য করা হতো। সেমতে এলাকা এবং আশেপাশের এলাকা এমনকি দুরবর্তী এলাকাতেও ধান চাউল নগদ টাকা-পয়সা আদায়ের ব্যবস্থা করা হতো। আর এ কাজে মাদরাসার তালবেএলেম বা ছাত্রদেরকেই ব্যবহার করা হতো। ছাত্রদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে দেওয়া হতো। রাহবার হিসেবে তাদের সঙ্গে থাকতেন একজন হুজুর (শিক্ষক)। খালি পায়ে গ্রামের এবড়ো থ্যাবড়ো ঘাঁটায় (রাস্তায় ) চলতে অনেক কষ্ট হতো। কিন্তু নেকি লাভের আশায় সেসব সহ্য করতে হতো। এছাড়া হাট আদায়ের দিন একটি বড় আকারের চাদর দুজন তালবেএলেম দুমাথা ধরে হাটের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতো। অন্যরা টিনের চোঙে মুখ লাগিয়ে দানের ফজিলত বর্ণনা করে হাটুরেদেরকে শুনাত্।ো
এর নেতৃত্বে থাকতেন একজন শিক্ষক হুজুর। হুজুরের নির্দেশে হাটে প্রবেশের পুর্বে কৌশল হিসেবে আগে থেকে চাদরের মধ্যে বেশ কিছু খুচরা পয়সা, কিছু কাঁচা টাকা ও নোট রেখে দেওয়া হতো। যাতে দানকারিরা মনে করে যে অনেকেই নেকির জন্য দান করেছে তাই নিজেরও কিছু দান করা কর্তব্য। তাতে আদায় বেশি হতো বলে হুজুর বলতেন। এছাড়া কিছু মেইন রাস্তার পাশে চেয়ার টেবিল পেতে দানের ফজিলত বর্ণনা করে মাদরাসার জালছার জন্য টাকা-পয়সা আদায় করা হতো।
মাদরাসার বার্ষিক জালসাকে কেন্দ্র করে এলাকায় আনন্দের ধুম পড়ে যেতো। প্রায় প্রতিটি বাড়ির মাটির ডোয়া-ধারি লেপাপোছা করা হতো। জালসার কদিন আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে আতপ চাউলের গুঁড়া তৈরির ধুম পড়ে যেতো । এদিন মেয়ে জামাই আত্মীয় কুটুম যারা আসবে তাদের জন্য বিভিন্ন ধরণের পিঠা তৈরির জন্যই আতপ চাউলের গুঁড়ার ব্যবস্থা করা হতো । তখন গোস্ত- রুটি আর হাতে প্রস্তুতকৃত সেমাইয়ের প্রচলন ছিলো খুব বেশি। চাউলের গুঁড়া গরম পানিতে গুলিয়ে খামির তৈরি করে তা পিঁড়ির উপর রেখে হাতের তালুর সাহায্যে সেমাই প্রস্তুত করা হতো । স্থানিয় ভাষায় একে বলা হতো ছই বা সেমাই। এই সেমাই রোদে শুকিয়ে তা তুলে রাখাা হতো। জালসার দিন খেজুরের কিংবা আখের গুড় ও গরুর খাটি দুধ দিয়ে তা পাক করা হতো । এদিন আমাদের বাড়িতে সেমাই ও পোলাও সহ ভালো খাবারের ব্যবস্থা হতো।
জালছার দুতিনদিন আগে থেকে এলাকার লোকজনের বাড়ি থেকে চৌকি জোগাড় করা হতো। কয়েকটি চৌকি জোড়া দিয়ে জালছার জন্য মঞ্চ তৈরি করা হতো। বাঁশের বাখারি দিয়ে মঞ্চের চারদিকে ধনুকের মত ঘের দেয়া হতো। তাতে জিগার গাছের আঠা দিয়ে খবরের কাগজ ও রঙিন কাগজ লাগিয়ে দেওয়া হতো। সেই সাথে রঙিন কাগজের ঝালরও লাগিয়ে দেওয়া হতো। রাতের বেলা জালছার মঞ্চে এবং আশে পাশে আলোর জন্য হ্যাজাক, ডে লাইট ইত্যাদি জ¦ালিয়ে রাখা হতো। এসময় মাইকের প্রচলন না থাকায় খালি কন্ঠে ওয়ায়েজিনদেরকে ওয়াজ নছিহত করতে হতো। শীতের রাতে যাতে শিশির না পড়ে সেজন্য মাথার ওপরে সামিয়ানা টানানো হতো। এসময় সামিয়ানা ভাড়া পাওয়ার কোন প্রচলন ছিলোনা। তাই নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য তা তৈরি করে নেওয়া হতো। যা পরবর্তী বছরে আবার কাজে ব্যবহার করা যেতো। মুসুল্লিদের বসার জন্য মাঠ থেকে ধানের নাড়া, খড় বা বিচালি এনে তা বিছিয়ে দেওয়া হতো।
জালছায় ভারতের মেদিনীপুর থেকে মওলানা আহম্মদ উল্লাহ পীর কেবলা সাহেব আসতেন এবং ওয়াজ করতেন। তিনি প্রথম যেবার আসেন সেবার তাঁর আগমণের জন্য মালিগাছা পাকা সড়ক হতে রুপপুর, শংকরপুর ও শ্রীকৃষ্টপুর হয়ে বাংগাবাড়িয়া মাদরাাসা পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা যা নাকি গাড়ির নিরিখ হিসেবে পরিচিত ছিলো তা কোদাল দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকার লোকজন সমতল করে দিত। তবে তা একেবারে সমতল হতোনা। ফলে বেশিরভাগ জায়গাতেই জিপ গাড়ি ঠেলা ধাক্কা দিয়ে আনতে হতো। আর এই কাজে মাদ্রাসার তাগড়া ও জোয়ান ছেলেদেরেকে উদ্বুদ্ধু করা হতো। নুরুল্লাহ হুজুর নছিহত করতেন এই বলে, ‘যব তম আপনা খেদমত বাচা লায়েগা, তু খাদেম ছে মাখদুম বন্ জায়েগা।’ অর্থাৎ যদি তুমি কারো খেদমত করো তবে তোমাকেও একসময় লোকে খেদমত করবে।’
আমি জিপ গাড়ি ঠেলতে বেশি আগ্রহি ছিলাম আর তা খেদমত পাবার আশায় নয়। পেট্্েরালের গন্ধ আমার কাছে বেশ প্রিয় ছিলো সেকারণেই আমি জিপ গাড়ি ঠেলতে হুজুরের কাছে নাম লেখা দিয়েছিলাম। গাড়ি ঠেলতে গিয়ে আমরা বেশ কষ্ট পাচ্ছিলাম। মেদিনীপুরের হুজুর জিপ থেকে নেমে আমাদের মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন।
মেদিনীপুরের হুজুর প্রধান বক্তা। অন্যান্যদের মধ্যে আটঘরিয়ার কদমবগদীর আবদুল্লাহ মওলানা, সাঁথিয়ার ধুলাউড়ির মওলানা নিজাম উদ্দিন, দাশুড়িয়ার মওলানা আতাউর রহমানসহ স্থানীয় আলেম-উলামাাগণ ওয়াজ-নছিহত করতেন। সারারাত ধরে জালছা চলতো। জালছায় ওয়াজ নছিহতের ধারা বুঝে মাদরাসার উন্নতির জন্য টাকা-পয়সা উঠানো হতো। দানের ওয়াজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসুল্লিরা নগদ টাকা-পয়সা দান করতো। বাঁকির প্রচলনও ছিলো। ধান, পাট, চাউল, যব, গম, ছোলা, মসুর , খেঁসাড়ি ইত্যাদি ফসল খাতায় লেখা দেওয়া হতো। কেউ কেউ জমির ফসলের ওশর দান করবেন বলে নাম লেখা দিতেন।
ফজরের নামাজের পর মিলাদ- কিয়াম ও দোয়া-দরুদ পাঠান্তে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে জালসার সমাপ্তি ঘটতো। জালসার এন্তেজামের চাউল ও টাকা থেকে মহিষ ক্রয় করা হতো। সেই গোশ্ত এবং চাাউল দিয়ে খিচুড়ি পাক করে তাবারকের ব্যবস্থ্যা করা হতো। তখন ১মন চাউলের মুল্য ছিলো ১২/১৩ টাকা এবং ৫০/৬০ টাকায় ৪/৫ মন ওজনের ১টি বড় আকারের মহিষ পাওয়া যেতো।
একবার জালছায় হুজুরদের সঙ্গে এক মজজুব অথাৎ আধা পাগলা লোক এসে জানায় যে, এই মাদরাসার পশ্চিম কোনে একজন আল্লাহর ওলি ঘুমিয়ে আছেন। তার মাজার রয়েছে এখানে। মাটি খুঁড়লেই তা পাওয়া যাবে। এই কথা মানুষের মুখে মুখে চাউড় হয়ে যায়। এলাকার লোকজন অন্ধ বিশ্বাসে প্রতি বৃহস্পতিবারে মাদরাসার লাইব্রেরি রুমের পাশে কাঁচের শিশি বোতলে এবং কাঁচের বয়ামে পানি ভর্তি করে রেখে যেতো এবং পরদিন শুক্রবার সকাল বেলা এসে সেই পানি নিয়ে যেতো। এতে নাকি লোকজনের অসুখ ভালো হয়ে যেতো।
সেসময় মাদরাসার হেড মওলানা ছিলেন দাপুনিয়া ইউনিয়নের খোঁকড়ার মরহুম বুজর্গ আওকাত উল্লাহ সাহেবের ছেলে মওলানা মোঃ আলাউদ্দিন। তিনি বলেন এসব র্শিক ও বেদা’ত, কোন অবস্থাতেই এটা বরদাস্ত করা হবেনা। তিনি লোকজনকে জানালেন, কিন্তু কেউই তার কথায় কর্ণপাত করেনা। অবশেষে একদিন তিনি রাগান্বিত হয়ে লাইব্রেরি রুমের পাশে রাখা শতাধিক শিশি বোতল ও বয়াম লাঠির আঘাতে ভেঙে ফেলেন। এ নিয়ে এলাকার মানুষজন দারুন অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং হেড মওলানার ওপর মারমুখি হয়।
মাদরাসায় বিরাট আকারের শালিস বসে। শালিসে হেড মওলানা সাহেবকে সকলে দায়ি করলেন। ফলে শিশি-বোতলের ক্ষতিপূরণও তাকেই দিতে হলো।
(ক্রমশঃ) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট